স্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছে দুর্বল পুলিশ বললেন টিআই আশিষ কুমার পাল

কাপ্তাই রাস্তার মাথার সিএনজি অটোরিক্সায় নেতা হারুন ও টিআই এর নামে মাসে ২৪ লাখ টাকা চাঁদাবাজি

Passenger Voice    |    ০৬:১২ পিএম, ২০২০-১২-০৭


কাপ্তাই রাস্তার মাথার সিএনজি অটোরিক্সায় নেতা হারুন ও টিআই এর নামে মাসে ২৪ লাখ টাকা চাঁদাবাজি

ইয়াছিন হক ও সাখাওয়াত উল্লাহ জুয়েলঃ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামের অফিসের বেবি টেক্সি চালক থেকে চট্টগ্রাম অটোরিক্সা অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়নের (রেজিঃনং ১৪৪১) সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ। চট্টগ্রাম মহানগরীতে অনিবন্ধিত সিএনজি অটোরিকশা পরিচালনায় বেশ কয়েকবার পুলিশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করে আলোচনায় আসা এই নেতা বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরীর কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকার সিএনজি অটোরিকশা চলাচল নিয়ন্ত্রন করে যাচ্ছে। দীর্ঘ দিন ধরে এই সিএনজি অটোরিকশায় এই নেতার লাঠিয়াল বাহিনীরা চাঁদাবাজী করলেও অদৃশ্য কারনে নিরব ভুমিকায় ছিল ট্রাফিক পুলিশ ।

শ্রমিক নেতার নামে দৈনিক চাঁদা ও ট্রাফিক পুলিশের নামে মাসিক চাঁদার বিনিময়ে চট্টগ্রাম জেলা এলাকার নিবন্ধিত দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রায় ১ হাজার ৫০০ এর অধিক সিএনজি অটোরিকশা চলাচল করছে নগরীর কাপ্তাই রাস্তার মাথা ও কালুরঘাট পর্যন্ত। নগরীর প্রবেশ মুখ গুলোতে যানজট ও জনজট হ্রাস করতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক পুলিশ কমিশনার মাহবুবুর রহমান এক বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিল এমনকি চট্টগ্রাম নগরীর অক্সিজেন মোড়ে দীর্ঘদিন ধরে চলা সিএনজি অটোরিকশা নৈরাজ্য বন্ধ করে মহানগর এলাকার বাহিরে বিআরটিসি বাস ডিপোর সামনে নিয়ে যায়। এই সময়ে নগর বাসীর দুর্ভোগ লাঘবে ভুমিকা রাখায় প্রশংসনীয় হয়েছিল সিএমপির এই শীর্ষ কর্মকর্তা। তবে ট্রাফিক পুলিশ ও সিএনজি নেতাদের যোগসাজসের  কারনে কাপ্তাই রাস্তার মাথার নৈরাজ্য বন্ধ করার চেষ্টা করেও তিনি পারেন নি।

প্যাসেঞ্জার ভয়েসের এক অনুসন্ধান বলছে, চট্টগ্রাম জেলার নজুমিয়ারহাট, গোলাপের দোকান হয়ে প্রতিদিন প্রায় ৮০০ এর মতো গ্রাম সিএনজি অবৈধভাবে ঢুকে পরছে শহরের অন্যতম প্রবেশ মুখ কাপ্তাই রাস্তার মাথায়। অন্যদিকে বোয়ালখালী থেকে কর্ণফুলী নদী হয়ে শহরের কালুরঘাট ও কাপ্তাই রাস্তার মাথা পর্যন্ত প্রতিদিন চলাচল করছে ৭০০ এর অধিক গ্রাম সিএনজি। শহরে চলাচলের পারমিটবিহীন এই গাড়িগুলোকে স্থানীয় পুলিশের মান্থলি নামে মাসিক মাসহারার টোকেন নিতে হয় ৫৫০ টাকা করে। এই দুই রুটে চলাচল করে প্রায় ১৫শ এর অধিক গ্রাম সিএনজি অটোরিক্সা যা মাসে প্রায়  ৮ লাখ ২৫ হাজার টাকার মতো পুলিশের নামে চাঁদা দিতে হয় । এছাড়া প্রতি ট্রিপে চালকদের লাইন খরচের নামে পাঁচ টাকা করে চাঁদা দিতে হয় চট্টগ্রাম অটোরিক্সা অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়নের (রেজিঃনং ১৪৪১) সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদের নামে । সিএনজি চালকদের ভাষ্যমতে একটি সিএনজি গড়ে প্রতিদিন পাঁচ থেকে সাতটি ট্রিপ দিয়ে থাকে। সে হিসেবে সিএনজি প্রতি ৩৫ টাকা করে ১৫০০ সিএনজি থেকে প্রতিদিন ৫২ হাজার ৫০০ টাকা, মাসে ১৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা লাইন খরচের নামে চাঁদা উত্তোলন করে এই শ্রমিক নেতা।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম অটোরিক্সা অটোটেম্পো শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, আমরা সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতি গাড়ি থেকে পাঁচ টাকা চাঁদা নিয়ে থাকি। গাড়িগুলো প্রতি মাসে ৫৫০ টাকার টোকেন দিয়ে চলাচলের বিষয়টা সত্য। এছাড়া গ্রাম থেকে শহরে আসা যাত্রীদের কষ্ট লাঘবে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই সিএনজি অটোরিক্সা চালানো হয়ে থাকে।

তবে নগরবাসি মনে করেন নগরীর পরিবহন সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য চট্টমেট্রো আঞ্চলিক কমিটি, চট্টগ্রাম জেলা আঞ্চলিক কমিটি, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআরটিএ ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মতো সংস্থা রয়েছে। এই চার সংস্থা ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তি পরিবহনের মানবিক চিন্তা করার কোন সুযোগ নেই। যা আইনে স্পষ্ট। হারুনুর রশিদ মূলত এই মানবিকতার দোহায় দিয়েই তার চাঁদাবাজির উৎস জিইয়ে রাখছে বছরের পর বছর।

এদিকে নগরীর প্রবেশ মুখে গ্রাম সিএনজি চলাচলের বিষয়ে চান্দগাঁও থানা এলাকার দায়িত্বে থাকা শহর ও  যানবাহন পরিদর্শক (টিআই) আশিষ কুমার পাল প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, আমরা প্রতিদিনই গ্রাম সিএনজি আটক  করছি তবে জনবল স্বল্পতা ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের কারনে আমরা পুরো দমে কাজ করতে পারছিনা। 

তবে ট্রাফিক পরিদর্শকের এমন বক্তব্য মানতে নারাজ পরিবহন বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন সৎ,দক্ষ এবং নীতিবান টিআই দের যদি চান্দগাঁও থানা এলাকার দায়িত্ব দেওয়া যায় তাহলে উক্ত কর্মকর্তার দক্ষতা ও সত্যতার সামনে এই পরিবহন মাফিয়ারা আত্মসমর্পণ করবে। এছাড়া ২০১৮ সালে সরকারের পক্ষ থেকে কমিউনিটি পুলিশ গঠন করার নির্দেশনা রয়েছে। পরিবহন সেক্টরে আলাদা কমিউনিটি পুলিশ গঠন করে সংশ্লিষ্ট টিআই রা তাদের সাথে নিয়ে কাজ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষনা দেওয়া 'তোমরা জনতার পুলিশ' হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারবে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক-উত্তর) মোখলেছুর রহমান প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, জেলায় চলাচলের জন্য নিবন্ধিত সিএনজি অটোরিক্সা শহরে প্রবেশ করা মাত্রই আমরা এগুলো আটক  করি, মামলা দিয়ে থাকি। এগুলো যাতে শহরে ঢুকতে না পারে সেদিকে আমাদের নজরদারি রয়েছে। গ্রাম সিএনজি শহরে ঢুকলেই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পুলিশের সামনেই সিএনজি অটোরিকশায় এমন নৈরাজ্য থাকলেও এইসব অনিয়মের বিরুদ্ধে দায়িত্বরত শহর ও যানবাহন পরিদর্শক কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় প্রশাসনের নিরব ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলছে সাধারণ মানুষ। অভিযোগ আছে পুলিশের কতিপয় দুর্নীতিবাজ সদস্যদের সাথে সিএনজির এই নেতা হারুনের সখ্যতা থাকায় সে তাদের দিয়ে এসব লাইন পরিচালনা করছে। তবে অভিযোগের তীর পুলিশের দিকে গেলেও নাটের গুরু সিএনজি নেতা হারুনুর রশিদ। কাপ্তাই রাস্তার মাথা ও কালুরঘাট এলাকার সিএনজি অটোরিকশার কলকাঠি নেড়ে প্রতি মাসে ২৪ লাখ টাকা হাতবদল করেন এই নেতা।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) শ্যামল কুমার নাথ প্যাসেঞ্জার ভয়েসকে বলেন, অধিকাংশ এলাকায় এই গাড়িগুলো শহরের বিভিন্ন উপ-সড়ক  এবং গ্রামের সাথে কানেক্টেড সড়ক গুলোতে লুকিয়ে চলাচল করে। তবে জেলায় নিবন্ধিত সিএনজি অটোরিক্সা যাতে শহরে প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারে সিএমপি ট্রাফিক জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছে। আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। গ্রাম সিএনজি পাওয়া মাত্রই আটক  করা হবে।

সূত্র বলছে, চট্টগ্রাম আঞ্চলিক ট্রান্সপোর্ট কমিটির নিয়মানুযায়ী মহানগরী এলাকায় সিএনজি ট্যাক্সি চলাচলের নির্দেশনা রয়েছে ১৩ হাজার। কিন্তু অতিরিক্ত পাঁচ হাজারেরও বেশি গ্রাম সিএনজি টেক্সি চলাচল করছে যা সম্পূর্ণরূপে অবৈধ। আইন  অনুযায়ী এগুলো চলাচল করবে চট্টগ্রাম জেলা এলাকায়। 

অনুসন্ধানে দেখা যায়, চট্টগ্রাম-থ-১৩-৮২৭৩,চট্টগ্রাম-থ-১৪-৭৫১০, চট্টগ্রাম-থ-১২-৮৬৯৩, চট্টগ্রাম-থ-১২-৯৭৬৬, চট্টগ্রাম-থ-১৩-০৮৫৬, চট্টগ্রাম-থ-১৩-২১০০, চট্টগ্রাম-থ-১১-১৪৬০, চট্টগ্রাম-থ-১২-৬০১৭, চট্টগ্রাম-থ-১৩-১৯৪৫, চট্টগ্রাম-থ-১৩-৯৩১২, চট্টগ্রাম-থ-১২-৮৬৯৩, চট্টগ্রাম-থ-১৪-৪৮৩৩, চট্টগ্রাম-থ-১৪-৩৩৮১, চট্টগ্রাম-থ-১৩-৫৩১৪, চট্টগ্রাম-থ-১৩-২১০০, চট্টগ্রাম-থ-১৩-১৯৪৫ সহ আরও  প্রায় ১৫ শ এর অধিক গ্রাম সিএনজি চলাচল করছে শহরের চান্দগাও থানার কাপ্তাই রাস্তার মাথা এবং কালুরঘাট এলাকায় চলাচল করছে।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে সড়ক পরিবহন আইনের ৭৭ নম্বর ধারায় অনুযায়ী এই গাড়িগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ট্রাফিক পুলিশের। সড়ক পরিবহন আইনের ৭৭ নম্বর ধারায় বলা আছে রুট পারমিট ব্যতীত পরিবহন যান চালনা বা চালনার অনুমতি দেওয়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এই অপরাধে অনধিক তিন মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। 

স্বচ্ছতা,জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সিএমপির পুলিশ কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর দায়িত্বশীল বেশকিছু পদক্ষেপ নিলেও মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তারা এইসব অনিয়মের সাথে জড়িত থাকায় এই নৈরাজ্যের তথ্য গুলো সিএমপি হেড কোয়াটার্স পর্যন্ত পোঁছায় না। সদিচ্ছা থাকার পরও এইসব বিষয়ে তিনি পদক্ষেপ নিতে পারছেন না বলে মনে করছেন স্থানীয় নগরবাসী।

আরও পড়ুন >>> ঘুষ ছাড়া মিলেনা ইকুরিয়া বিআরটিএতে ড্রাইভিং লাইসেন্স

আরও পড়ুন >>> শব্দদূষণে শ্রবণ সমস্যায় ভুগছে ৬৪% ট্রাফিক পুলিশ

আরও পড়ুন >>> বিআরটিএর দুর্নীতির সম্রাট সহকারী পরিচালক আইয়ুব আনসারী পর্ব-১

আরও পড়ুন >>> “‌নো মাস্ক নো প্যাসেঞ্জার” জনসচেতনতায় সিএমপি ট্রাফিক পুলিশ